রোবট এর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

 রোবট বা রোবটিক্স কি?

রোবটিক্স হলো টেকনোলজির একটি শাখা যেখানে রোবট নিয়ে আলোচনা করা হয়। ‘রোবট’ শব্দটির অর্থ বাংলায় দাড় করালে হয় যন্ত্রমানব; মানুষের যান্ত্রিক রূপকে রোবট বলা হয়। কিন্তু মানুষ কীভাবে যন্ত্র হয়? সেটা একটা কনফিউজিং প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

রোবট বা রোবটিক্স কি?

ব্যাপারটা আরও কনফিউজিং হয়ে যায় তখন, যখন একবিংশ শতাব্দীতে এসে শুনতে হয়, যন্ত্রকে বানানো হচ্ছে মানুষেরই বিকল্প হিসেবে। এর মানে মানুষের প্রয়োজন কি ফুরিয়ে আসছে? তাহলে কি ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে মানুষের বিকল্প হিসেবে এই রোবট দ্বারাই সব কাজ করানো হবেমানুষের কাজগুলো সব যদি রোবট দিয়ে করানো হয়, বেকারত্ব সমস্যা কি তাহলে ভবিষ্যতে আকাশ ছুঁই ছুঁই করবে না?

রোবটিক্স নিয়ে আলোচনায় বসলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয় রোবটবিপ্লবের বিষয়টি। বর্তমানে যে হারে রোবট টেকনোলজির উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে তাতে অপার সম্ভাবনাময় কিছু রোবটের উদ্ভাবন আশা করা যায়, যে রোবটগুলো হবে আল্ট্রা ইন্টেলিজেন্ট, তাঁদের বুদ্ধিমত্তা ছাড়িয়ে যাবে মানুষকেও।

 

এই প্রেক্ষিতে সবার প্রথমে আমার এক রোবটরমণীর কথা মনে পড়ে যায়, সৈদি আরবে নাগরিকত্ব পাওয়া সোফিয়া রোবটটির নাম শুনেনিই কিংবা ইন্টারনেটে সোফিয়ার ছবি বা ভিডিও চোখে পড়েনি, এরকম মানুষ মনে হয়না পাওয়া যাবে! 


রোবটিক্সের ভবিষ্যৎ


রোবটিক্সের ডেভেলপমেন্ট কি আমাদের জন্য স্বস্তিকর হবে? নাকি এই প্রযুক্তির অগ্রগতি সাধন করতে গিয়ে আমরা নিজেদের জন্যই বড় বিপদ ডেকে আনছি!

কি মনে হয়, খাল কেটে কুমির ডেকে আনার কাজটা কত নিঁখুতভাবেই করে চলেছে আমাদের রোবটনির্মাতারা, তাইনা?

রোবটিক্স এর ব্যাপারটা রোবট পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকা প্রয়োজন ছিল, বাড়াবাড়ি হলো তখনই যখন এর সাথে Artificial Intelligence বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি জুড়ে দেওয়া হলো। আমরা মানুষ; মানুষ মাত্রই ভুল, তাই কাজের ক্ষেত্রে আমাদের ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে ভুলের উর্ধ্বে বলা যায়, কারণ এটিকে যে কাজের জন্য প্রোগ্রাম করা হয় এটি সেই কাজটি নিঁখুতভাবে করতে পারে, অর্থাৎ, এই দিক থেকে তুলনা করলে রোবট already মানুুষের ability কে অতিক্রম করে ফেলেছে।


AI Technology এর সবচেয়ে বড় সফলতা হবে আবেগপ্রবণ রোবট সৃষ্টি। অর্থাৎ বিজ্ঞানিরা এমন রোবট সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে যারা আবেগ দ্বারা তাড়িত হবে, তারা যেকোনো অনুভূতিকে নিজের মদ্ধ্যে গ্রহণ করতে পারবে, প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো তারা মানুষের মতো অনুধাবন করতে শিখে যাবে। এরকম রোবট সৃষ্টির সম্ভাবনা বর্তমানে AI Technology প্রেক্ষিতে ব্যাপক। কিন্তু এরূপ যদি সম্ভব হয়, আবেগতাড়িত রোবট সভ্যতা পৃথিবীতে মানুষের দাসত্ব না করে বরং মানুষের মতোই এই সৃষ্টিজগতে রাজত্ব করতে চাইবে। আর একই রাজ্যে দুইজন রাজা টিকতে পারবে না কখনো, ফলে হলিউডে দেখা সাইফাই মুভিগুলোর মতো মানুষ বনাম রোবট এর যুদ্ধ কেউ আটকাতে পারবে না।

 

অর্থাৎ রোবটিক্স টেকনোলজি নিয়ন্ত্রণে না রাখা গেলে ভবিষ্যতে এর কারণে আমাদের মানবসভ্যতা হুমকির মুখে পড়বে। শেষমেষ মানবসৃষ্ট এই রোবটিক্স টেকনোলজি না মানবসভ্যতার বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাড়ায়!

মানুষের চিন্তাক্ষমতা, বিশ্লেষণদক্ষতা ও বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তা আধুনিক বিজ্ঞানের প্রযুক্তিগত যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন এবং সে অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আধুনিক বিজ্ঞানের এক অনন্য আশীর্বাদ। অত্যাশ্চর্য এই আশীর্বাদের ফলাফল হিসেবে মানুষ নির্মিত কৃত্রিম যন্ত্রগুলো মানুষের মতো অনুধাবন এবং সে অনুযায়ী প্রতিকূল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম! বিখ্যাত দার্শনিক ও গণিতবিদ রামোন লোল ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে গল্প ও কৌতুক বলার উপযোগী এবং বিশ্লেষণধর্মী যুক্তি উপস্থাপন করতে পারদর্শী একটি যন্ত্র তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। গণিতজ্ঞ গটফ্রিড লিবনিজ লোলের আবিষ্কৃত ক্যালকুলাস রেটিওসিনেটর ব্যবহার করে ভাষা বোধগম্য মেশিন প্রস্তুতের এই ধারণাকে আরও প্রসারিত করেন। আর এর বাস্তবসম্মত রূপদান করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এ্যালান টুরিং।


গাণিতিক যুক্তিবিজ্ঞান অধ্যয়নকালে গণিতের এক বিস্ময়কর তত্ত্বের সূত্রপাতের মাধ্যমে তিনি দেখাতে সক্ষম হন যে, গাণিতিক রাশি ‘০’ ও ‘১’ ব্যবহার করে মানুষের চিন্তাভাবনাকে মেশিনের বোধগম্য ভাষায় রূপান্তর করা সম্ভব। তার এই প্রায়োগিক তত্ত্ব সে সময় বিজ্ঞানীমহলে ভূয়সী প্রশংসা কুড়ায়। বিশেষ করে স্নায়ুবিদ্যা, তথ্য তত্ত্ব ও সাইবারনেটিক্সের গবেষকদের জন্য বৈদ্যুতিক মস্তিষ্ক নির্মাণের সম্ভাবনাকে এটি বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণে, যা বর্তমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিক্স প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটায়। আজকাল রোবট বেশ আলোচনা আর আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। কিছুদিন আগেও বেশ আলোচনামুখর একটা বিষয়বস্তু ছিল হিউম্যান রোবট সোফিয়া। রাজধানী ঢাকার গুলশানে কোন একটা রেস্টুরেন্ট এ লাইন ফলোয়ার রোবট নাকি যাবতীয় কাজ করছে। খাবার পরিবেশন করছে।


রোবট নিয়ে আরও কি সব মজার মজার অদ্ভুত অদ্ভুত সব গবেষণা চলছে শুনলাম। তো আসুন আপনাদের ও শুনাই সেই সব। World Economic Forum এর জরিপ অনুযায়ী আগামী রোবট ইতোমধ্যে Blue Collar Industry তে কাজ করা শুরু করেছে। খুব দ্রুত তারা White Collar Industry তে ও কাজ শুরু করবে। ইতোমধ্যে রোবট ফার্মাসিস্ট হিসেবে ও কাজ করছে। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করি বলি। একজন ফার্মাসিস্ট এর ৫/৬ বছরের ট্রেনিং/কাজের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তিনি এটা নিশ্চিত করেন যে আপনি সঠিক ঔষধ সঠিক মাত্রায় পাচ্ছেন কি না! কিন্তু এখন গবেষকরা ধারণা করছেন যে, একজন মানুষের যে কাজ করতে চার/পাঁচ বছরের জ্ঞান খাটাতে হয়, একটা রোবট নিমিষেই সে কাজ করে দিতে পারে।


Houston Medical Centre এর একটা মেডিক্যাল স্টাডি তে দেখা যায় যে, তাদের ফার্মাসিস্ট প্রতি ১০ হাজার প্রেসক্রিপশনে ৫ টা ভুল করে থাকেন। হ্যাঁ এটা কথা সত্য যে, একজন মানুষের জন্য ১০ হাজারে ৫ টা ভুল আহামরি কিছু নয়। কিন্তু এটা অন্য একজন মানুষের জীবনের প্রশ্ন। তাই এইটুকু ঝুঁকিও বা আমরা কেন নিবো যেখানে গবেষণা অনুযায়ী রোবট প্রায় বিনা ভুলে সঠিক চিকিৎসা দিতে সক্ষম হচ্ছে। এবার তবে একটা চমকপ্রদ খবর দেই। Ingestible Robot, এটা এমন এক ধরনের রোবট যা কি না মানুষের খাদ্যনালী এবং পেটের ভিতর ঘুরে বেড়াতে পারে। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনেছেন। এরকম একটা রোবটই আসতে চলেছে ২০২৪ সালের দিকে।


১৯৬৬ সালে Fantastic Voyge নামের একটা মুভিতে এমন একটা জগত কে দেখানো হয়েছিল যেখানে মানুষকে একদম মাইক্রোস্কোপিক আকারের করে দেয়া হতো এবং তাদের কাজ ছিল অসুস্থ মানুষদের ভিতরে প্রবেশ করে তাদের রোগমুক্ত করা। প্রায় ৫০ বছর পর সেই কনসেপ্ট কে বাস্তবায়ন করে MIT i CSAIL (Computer Science & Artificial Intelligence Laboratory) তে এই Ingestible Origami Robot নিয়ে কাজ করে একদল গবেষক। ১৯৮৫ সালে রোবট দিয়ে Stereotatic brain biopsy করা হয়। ঠিক তার পরের বছরই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিতম্ব প্রতিস্থাপন, এন্ডোস্কপি এবং অন্যান্য কিছু ছোটখাটো রোগের চিকিৎসা করা হয়। ২০১৬ সালের শেষের দিকে প্রফেসর ডেনিয়েল রুস এবং তার দল মিলে এমন একটা Ingestible Robot ডিজাইন করেন যা কি না চৌম্বকক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ এর মাধ্যমে মানব শরীরের অভ্যন্তরে গিয়ে নানা রকম রোগের চিকিৎসা করতে পারবে।


ধারণ করা হয় যে, আনুমানিক ২০২৪ সালের দিকেই চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই ধরনের রোবটের ব্যবহার শুরু হবে। আচ্ছা, এতক্ষণে আপনার নিশ্চয়ই খুব জানতে ইচ্ছা করছে যে, এমন একটা রোবট ঠিক কি দিয়ে তৈরি হতে পারে? খুব অবাক করা হলেও সত্যি যে এটা শুকরের শুকনো অন্ত্র আর চুম্বক দিয়ে তৈরি। বর্তমান প্রবণতার ভিত্তিতে ধরে নেওয়া যায়, যে নানা ধরনের রোবটের বাজার আগামী ১০ বছরে সম্ভবত তিন গুণ বেড়ে যাবে। এর অর্থ, ভবিষ্যতে প্রায়ই আমাদের সঙ্গে রোবটের দেখাসাক্ষাৎ হবে। এমন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের মনে ভয়ভীতি হবে, নাকি আমরা সহজেই তা মেনে নেবো? দেশ অনুযায়ী সম্ভবত এই মনোভাব নির্ভর করে। মানুষ কতটা খুশিমনে অথবা বিরক্তির সঙ্গে রোবটের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করে, তাৎসিয়া নোমুরা সেই বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। একটি গবেষণার আওতায় তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা ৭টি দেশের মানুষের কাছে কিছু প্রশ্ন রেখেছিলেন। ব্রিটেন, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, মেক্সিকো, চীন, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই গবেষণা চালানো হয়।


তাতে জানা গেল, যে আমেরিকার মানুষ রোবটদের বিষয়ে সবচেয়ে অনুকূল প্রতিক্রিয়া দেখান। তার পরেই জাপান, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, চীন ও ব্রিটেনের স্থান। কিন্তু মেক্সিকোর মানুষ এ বিষয়ে অত্যন্ত নেতিবাতক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। প্রো. নোমুরা বলেন, ‘মানুষ রোবটকে ভাল না মন্দ মনে করেন, সেটি শুধু দেশের উপর নির্ভর করছে না। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যেও ফারাক দেখা যায়। জাপানে সব প্রজন্মই রোবট পছন্দ করে। আবার ব্রিটেনে শুধু তরুণ প্রজন্মের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। বয়স্করা এটি পছন্দ করেন না। দিনদিন রোবটের ব্যবহার বাড়ছেই।


সিঙ্গাপুরের বেশিরভাগ হোটেলেই ব্যবহার হচ্ছে রোবট। অবিকল মানুষ। এমনকি অন্য কাজেও রোবট ব্যবহৃত হচ্ছে সে দেশে এবং তা ক্রমান্বয়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থা জাপানেও। সেখানে সিঙ্গেল নর-নারীর সংখ্যা ৬০ শতাংশেরও বেশি। আবার তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশই কুমারী। সম্প্রতি স্থানীয় জনসংখ্যা ও সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালিত এক সমীক্ষার ফলাফল থেকে জানা গেছে জাপানের ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সী ৭০ শতাংশ অবিবাহিত পুরুষ এবং ৬০ শতাংশ অবিবাহিত নারীর জীবনে কোন প্রেমের সম্পর্ক নেই। শুধু তাই নয়, এদের মধ্যে ৪২ শতাংশ পুরুষ ও ৪৪.২ শতাংশ নারী বলেছেন, তারা এখনও কুমার অথবা কুমারী। অর্থাৎ তাদের যৌনমিলন বা সেক্সের কোন অভিজ্ঞতাই নেই।


ফলে জনসংখ্যা সঙ্কটে যেন হিমশিম খাচ্ছে জাপান। একদিকে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে কমে যাচ্ছে জন্মহার। সাধারণত মানুষ কোন কাজ করার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ও পরবর্তীতে আরও উন্নতভাবে কাজটি করতে পারে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্র তা পারছে না। এটি তার ভেতরের সফটওয়্যারে যা প্রবেশ করানো আছে সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারে। রোবট যন্ত্রগুলোর ভিতরে থাকা প্রোগ্রাম অনুযায়ী কাজ করে। কাজটি সঠিক নাকি ভুল হলো সে সম্পর্কে কোন ধারণা করতে পারে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধা ও অসুবিধা বিবেচনায় বিজ্ঞানের উচিত এই ব্যবস্থাকে মানবকল্যাণে কীভাবে ব্যবহার করা যায় সে সম্পর্কে বিস্তর গবেষণা করা। এছাড়াও এই ব্যবস্থার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল না হয়ে সুষমভাবে ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া।

 ★বিভিন্ন টেকনোলজি ও টিপস রিলেটেড পোষ্ট দেখতে চোখ রাখুন আমাদের ওয়েবসাইটে

Next Post Previous Post