ডেভিড লুইজ- সিংহ কেশরের এক ব্রাজিলিয়ান

ম্যাচের তখন ৬৮ মিনিট চলছে। গোলবার থেকে বহুদূরে ফ্রি কিক পেয়েছে ব্রাজিল। ফ্রি কিক নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে হাল্ক ও ডেভিড লুইজ। ফ্রি কিক নেওয়ার জন্য দৌড় দিলেন ঝাঁকড়া চুলওয়ালা সেন্টারব্যাক। এরপর একটা স্বপ্নীল ফ্রিকিক। কলম্বিয়ান গোলকিপার অস্পিনাকে ফাঁকি দিয়ে বল জড়িয়ে গেছে জালে। অন্যদিকে স্বপ্নে দেখা গোল করার আনন্দে সিংহের কেশরের মতো চুলগুলোকে উড়িয়ে উদযাপনে ব্যস্ত লুইজ! সেদিনের সেই আইকনিক সেলেব্রেশনটা ফুটবলপ্রেমীদের মনে গেঁথে গিয়েছে বেশকিছুদিনের জন্যই।



ডেভিড লুইজ এর ক্যারিয়ার :

ডেভিড লুইজ ক্যারিয়ারের শুরুতে আদতে সেন্টার-ব্যাক ছিলেন না। ভিটোরিয়াতে যখন ক্যারিয়ার শুরু করেন তখন খেলতেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। পারফরমেন্স বাজে হওয়ার দরুণ ক্লাব প্রায় ওকে ছেড়েই দিচ্ছিলো। তখন হঠাৎ ডিফেন্সিভ মিড থেকে বানানো হলো ওকে সেন্টারব্যাক। নতুন পজিশনে যেন নিজেকে নতুনভাবে খুঁজে পেলো লুইজ। ভিটোরিয়াতে ভালো পারফরমেন্স দেখানোর দরুণ ২০০৭ এর সামারে লোনে বেনফিকায় যোগ দেয়। পরবর্তী সিজনে লুইজকে পারমানেন্টলি সাইন করিয়ে নেয় পর্তুগিজ ক্লাবটি।


নতুন ক্লাবে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় নিচ্ছিলো। ২০০৯ এ বেনফিকার কোচ হয়ে আসে হোর্হে জেসুস। তার অধীনে লুইজ পায় ভাইস ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব। হয়ে উঠে ডিফেন্সে ক্লাবে এক ভরসার প্রতীক। ৫ সিজন পরে বেনফিকা জিতে নেয় সেবার লীগ টাইটেল। সে সিজনে ক্লাবের হয়ে ৪৯টি ম্যাচে মাঠে নামে ও। সিজনশেষে ডি মারিয়াকে পেছনে ফেলে পর্তুগিজ লীগের সেরা খেলোয়াড়ের খেতাবটাও করে নেয় নিজের। উল্লেখ্য, লুইজ পেয়েছিলো ৩৮% ভোট, যেখানে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ডি মারিয়া পেয়েছিলো মাত্র ৮% ভোট! 

চেলসিতে যোগদান :

২০১১ এর জানুয়ারিতে বেনফিকা থেকে চেলসিতে যোগ দেয় লুইজ। ক্লাবে যোগ দিয়েই চেলসির ফ্যান্সদের প্রিয় একজন হয়ে উঠেন খুব তাড়াতাড়িই। সে বছরের মার্চে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটির সাথে গোল করে লুইজ। ফলস্বরূপ ক্লাবে যোগ দেয়ার ৩ মাসের ভেতরেই লীগের প্লেয়ার অফ দ্যা মান্থ এওয়ার্ড জিতে নেয় এই সেন্টারব্যাক। 

ইউরোপ সেরা :

পরের সিজনে চেলসি নিজেদের ইতিহাস বদলে নেয়। প্রথমবারের মতো ইউরোপ সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করে লন্ডনের নীল দলটি। সেখানেও অনবদ্য ভূমিকা রাখে লুইজ। সেকেন্ড রাউন্ডে নাপোলির সাথে নজরকাড়া পারফরমেন্স উপহার দেয়। ফলস্বরূপ ইউয়েফা থেকে জিতে নেয় ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ এওয়ার্ড। ইঞ্জুরির কারণে সেমিফাইনাল খেলতে না পারলেও বায়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে ফাইনালে পুরো ১২০ মিনিটই খেলে লুইজ। টাইব্রেকারে দলের হয়ে গোলও করে। পরবর্তীতে চেলসির সাথে প্রথমবারের মতো ইউরোপ সেরা হওয়ার কৃতিত্বও অর্জন করে নেয় লুইজ। 

পিএসজিতে যোগদান :

এরপর আরো দুই সিজন চেলসির সাথে কাটানোর পর লুইজ যোগ দেয় পিএসজিতে। তৎকালীন ডিফেন্ডারদের ওয়ার্ল্ড রেকর্ড, ৫০ মিলিয়ন ফী'র বিনিময়ে ব্রাজিলিয়ান এই সেন্টারব্যাককে দলে ভেড়ায় ফ্রেঞ্চ জায়ান্টরা। সেবছর ফিফার টিম অফ দ্যা ইয়ারেও জায়গা করে নেয় লুইজ। পিএসজিতে যোগ দেয়ার সিজনেই ইউসিএলে চেলসির সাথে রাউন্ড অফ সিক্সটিনে মুখোমুখি হয়। পুরনো ক্লাবকে হারিয়ে কোয়ার্টারে চলে যায় লুইজের নতুন দল যেখানে গোল করে লুইজ। পিএসজিতে যোগ দেয়ার প্রথম দুই সিজনেই ডমেস্টিক ট্রেবল জিতে নেয়।


এরপর পিএসজি থেকে আবারো চেলসিতে আসে লুইজ। সেখানে কিছুদিন কাটানোর পর লন্ডনের আরেক ক্লাব আর্সেনালে যোগ দেয়। আর্সেনালে নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময়টুকু কাটায় ও। এক সিজনে ৫টা পেনাল্টি কন্সিড করার দুঃসহ রেকর্ড গড়ে এই সেন্টারব্যাক। এরপর লুইজ ইউরোপ ছেড়ে চলে যায় স্বদেশে। ফ্লামেঙ্গোর হয়ে এখন ক্যারিয়ারের পড়ন্ত লগ্নের সময়টুকু কাটাচ্ছে একসময়ের আলোচিত এই সেন্টারব্যাক।

দক্ষতা :

ক্যারিয়ারে ডিফেন্সের পাশাপাশি গোলস্কোরিং দক্ষতাও ভালো ছিলো। ওয়ালের উপর দিয়ে বল পাঠিয়ে হুট করেই আবার গোলপোস্টের নিচে নেমে যাওয়ার মতো ফ্রিকিক নেয়ার টেকনিক রপ্ত করে নিয়েছিলেন। বেশ কিছু ফ্রিকিক গোলও রয়েছে ক্যারিয়ারে তাই ওর। 

অভিষেক :

২০১০ এ ব্রাজিলের হয়ে অভিষেক হয় ওর। বেনফিকায় তখন লুইজের পারফরমেন্সের দরুণ পর্তুগালের ফেডারেশন ওকে পর্তুগালের হয়ে খেলার অনুরোধও করেছিলো। কিন্ত লুইজ ব্রাজিলের হয়েই শেষ পর্যন্ত খেলার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৩ এর কনফেডারেশন কাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলো লুইজ। ফাইনালে পেদ্রোর নেয়া শটের গোল লাইন ক্লিয়ারেন্সটা ব্রাজিলের সমর্থকরা কি আদৌ মন থেকে মুছতে পারবে? 

গোল ডিটেইলস :

পরবর্তী বছরের বিশ্বকাপের স্কোয়াডেও জায়গা করে নেয় ও। রাউন্ড অফ সিক্সটিনের ম্যাচে চিলির বিপক্ষে ১-১ গোল ড্র হয় ম্যাচ। পরবর্তীতে টাইব্রেকারে ব্রাজিল জয়লাভ করে। সেই ম্যাচেও ব্রাজিলের হয়ে গোল করে লুইজ। ব্রাজিলের হয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম গোল ছিলো সেটিই। এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে সেই বিখ্যাত ফ্রিকিক আর সেলেব্রেশন! ডেভিড লুইজ যেন একটা এক্সাইটিং প্যাকেজ।

যেভাবে হয়ে উঠে সেন্টার-ব্যাক :

ক্যারিয়ারের পুরোটাই কাটিয়েছে আপ্স এন্ড ডাউন্সের মধ্য দিয়ে। ক্যারিয়ারের শুরুতে ছিলেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। সেখান থেকে হয়ে যান সেন্টারব্যাক। খেলতে পারতেন ফুলব্যাক হিসেবেও। লুইজের ফিজিকালিটি, টেকনিক ছিলো ভালো। বল ডিস্ট্রিবিউশনের পাশাপাশি দূরপাল্লার শটেও ছিলো ভালো দক্ষতা। ব্রাজিলের আরেক লিজেন্ড রিকার্ডো কাকাকে মানতেন ব্যক্তিজীবনের আইডল হিসেবে। আশ্চর্য্যজনকভাবে দুজনের জন্মদিনটাও একই দিনে!


কনফেডারেশন কাপের সেই গোললাইন ক্লিয়ারেন্স কিংবা কলম্বিয়ার সাথে ফ্রিকিকের পর সেই ভো দৌড়! ডেভিড লুইজের ক্যারিয়ারকে ব্যাখ্যা করতে গেলে মানসপটে এই দুটি চিত্র ভেসে উঠেই।


সময় নিয়ে পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। 🥰 নিত্যদিনের খেলার সংবাদ পেতে চোখ রাখুন আমাদের সাইট এ। আজকের মতো এখানেই শেষ। আল্লাহ হাফেজ 💙

Next Post Previous Post